ময়লার গাড়ি এখন নয়া ঘাতক
মৃত্যু জীবনের এক বাস্তবতা। এটি অস্বীকার করার সুযোগ বা সাধ্য জগৎ সংসারে কারো নেই। সড়ক দুর্ঘটনায় যেভাবে মৃত্যু হচ্ছে তা মেনে নেয়া যায় না। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) ভাষ্য অনুযায়ী, গত বছরের প্রথম তিন মাসের তুলনায় চলতি বছর দুর্ঘটনা বেড়েছে ৪৩.৯৫ শতাংশ এবং মৃত্যু বেড়েছে ৩০ শতাংশ। জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত সময়ে এক হাজার ৪৬৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় এক হাজার ৩৬৭ নিহত ও এক হাজার ৭৭৮ জন আহত হয়েছেন। (সূত্র ডেইলি স্টার, ৮ এপ্রিল, ২০২৪) শিশু-কিশোর-যুবক থেকে শুরু করে সব বয়সী মানুষ সড়কে প্রাণ হারাচ্ছে। ঘর থেকে বের হয়ে নিরাপদে ঘরে ফেরা নিয়ে সর্বত্র সংশয়।
নতুন আতঙ্কের নাম রাজধানী ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ি। কেড়ে নিচ্ছে নগরবাসীর প্রাণ। গত ৯ বছরে শিক্ষার্থীসহ ২০ জনের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ি। সর্বশেষ গত ২৫ এপ্রিল ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ি মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র মাহিনের প্রাণ কেড়ে নেয়। এ বিয়োগান্ত ঘটনায় মাহিনের পরিবারকে সান্ত্বনা দেয়ার ভাষা আমাদের জানা নেই।
সিটি করপোরেশনের ময়লা গাড়ি নাগরিকদের সেবা দেয়ার জন্য রাস্তায় চলাচল করে। এখন এগুলো কেড়ে নিচ্ছে জীবন? প্রায় প্রতিটি দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে দেখা গেছে, নির্ধারিত চালকের পরিবর্তে অন্যরা গাড়িচালকের আসনে ছিল। ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকা সত্ত্বেও তাদের হাতে গাড়ির চাবি তুলে দেয়া হচ্ছে। এতগুলো মানুষের জীবন কারো কারো কাছে তুচ্ছ মনে হতে পারে! কিন্তু‘ স্বজনদের কাছে তারা অত্যন্ত প্রিয়। প্রতিটি দুর্ঘটনা ঘটার পর তদন্ত হয়। কিছু কর্তা স্বজনহারা পরিবারে সান্ত্বনার দেন। যেকোনো প্রয়োজনে তাদের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতিও দেন। কিন্তু দিন কয়েক পর যখন নতুন আরেকটি দুর্ঘটনা ঘটে, তখন আর ওই পরিবারের কথা মনে পড়ে না। অথচ একটি পরিবারে যখন শোকের ছায়া নেমে আসে তখন পুরো পরিবারকে যুগ যুগ ধরে সে শোক বইতে হয়। প্রতিটি দুর্ঘটনার শিকার পরিবারকে সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেয়ার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। যেন পরিবারগুলোকে ভিক্ষাবৃত্তিতে নামতে না হয।
২০১৮ সালের ২৯ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট রাজপথে সাধারণ শিক্ষার্থীরা নিরাপদ সড়ক দাবিতে আন্দোলন করেছিল। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন জাতির চোখ খুলে দিয়েছিল। রাষ্ট্র মেরামত করার স্লোগান উচ্চারিত হয়েছিল। কিছু দিন সড়কে শৃঙ্খলাও ছিল। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ওই সময় সড়কে শৃঙ্খলার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল যে, ঢাকায় অবস্থিত সব সংস্থার আওতাধীন যানবাহন ও কর্মচারীরা যেন ট্রাফিক আইন মেনে চলে। ওই পর্যন্তই শেষ। এখন আর কেউ নির্দেশনা মানছে না। ক্ষমতার দাপটে অনেকে উল্টোপথে গাড়ি চালাতেও দ্বিধাবোধ করছে না।
সিটি করপোরেশনের ময়লা সরানোর সময় রাত ১০টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত। কিন্তু দিনের বেলায়ও ময়লা পরিবহনের গাড়ি রাজধানীর বিভিন্ন রাস্তায় চলছে। ২০২১ সালের নভেম্বরে প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুসারে, দুই সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ি চালকদের অনেকেরই ভারী যান চালানোর লাইসেন্স নেই, মশককর্মী, পরিচ্ছন্নতাকর্মী ও বাইরের লোকজন দিয়ে এসব ভারী যানবাহন চালানো হচ্ছে। এ কাজে সিটি করপোরেশনের পরিবহন বিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তা সহযোগিতা করছেন। ‘টাকার বিনিময়ে পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের হাতে বর্জ্য পরিবহনের গাড়ি’ দেয়ার অভিযোগ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। (সূত্র ৬ জুন ২০২৩, দৈনিক প্রথম আলো)
বছরের পর বছর এমন কাণ্ড ঘটে চললেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের টনক নড়েনি। ফলে ময়লা গাড়ির ধাক্কায় দীর্ঘ হচ্ছে লাশের মিছিল। এসব ঘটনাকে দুর্ঘটনা না বলে হত্যাকাণ্ড বলতে হবে।
ময়লার গাড়ি নগরবাসীর প্রাণ কেড়ে নেয়ার কিছু পরিসংখ্যান তুলে ধরা হলো :
২০২৩ সালের ৬ মার্চ ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ময়লাবাহী গাড়িচাপায় আবু তৈয়ব নামে এক কাপড় ব্যবসায়ীর মৃত্য হয়। ২০২২ সালের ২ এপ্রিল রাজধানীর খিলগাঁওয়ে ডিএনসিসির ময়লার গাড়ির ধাক্কায় নাসরিন খানম নামে এক নারী নিহত হন। ২৩ জানুয়ারি মহাখালীর উড়াল সড়কের কাছে ময়লার গাড়ির ধাক্কায় শিখা রানী ঘরামি নামে এক নারীর মৃত্যু হয়। তিনি ডিএনসিসির পরিচ্ছন্নতাকর্মী ছিলেন।
২০২২ সালের জুলাইয়ে মিরপুরে পুলিশ স্টাফ কলেজের সামনে ময়লার গাড়ির ধাক্কায় সাব্বির আহমেদ নামে এক তরুণের মৃত্যু হয়। ২০২২ সালের ৩১ মে রাজধানী মুগদার টিটিপাড়া মোড়ে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ময়লা গাড়ির ধাক্কায় নাজমা বেগম নামে এক নারীর মৃত্যু হয়। ২০২২ সালে ময়লার গাড়ির ধাক্কায় অন্তত চারজন মৃত্যুবরণ করেন।
২০২১ সালের ২৪ নভেম্বর রাজধানীর গুলিস্তানে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ির ধাক্কায় নটর ডেম কলেজের ছাত্র নাঈম হাসানের মৃত্যু হয়। এর একদিন পর ২৫ নভেম্বর দুপুরে পান্থপথ এলাকায় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ১০ চাকার ডাম্প ট্রাকের ধাক্কায় প্রথম আলোর সাবেক সংবাদকর্মী আহসান কবীর খানের মৃত্যু হয়। হানিফ নামে এক বহিরাগত চালক গাড়িটি চালিয়েছিল। ২০২১ সালের ২৩ ডিসেম্বর ওয়ারী এলাকায় ময়লার গাড়ির ধাক্কায় স্বপন কুমার সরকার নামে এক মজুরের মৃত্যু হয়। উপরোক্ত ঘটনাগুলো প্রমাণ করে- দুই সিটি করপোরেশনের জবাবদিহি না থাকায় বারবার সড়কে রক্ত ঝরছে। কিন্তু এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ প্রতিরোধ সেভাবে গড়ে উঠছে না। ফলে বারবার দুর্ঘটনা ঘটেছে। এজন্য দায়ী কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের আইনের আওতায় আনা এবং আর্থিক জরিমানার বিধান নিশ্চিত করা দরকার। যেন ময়লার গাড়ির নিচে আর কোনো মাহিনের জীবন চলে না যায়।