অধ্যাপক এবিএম ফজলুল করীম \
পৃথিবীতে যেমন অনেক জাতির মানুষ রয়েছে, তেমনি রয়েছে তাদের আনন্দ, বেদনা প্রকাশের বিভিন্ন ধরনের বিশেষ দিন। অন্যান্য জাতির মতো মুসলমানদের কতগুলো স্মরণীয় দিন রয়েছে, যেসব দিনে তারা নানা আনন্দ উৎসব পালন করে থাকে। কিন্তু ঈদের আনন্দ ও অন্যান্য আনন্দের মধ্যে অনেক পার্থক্য বিদ্যমান। মহান আল্লাহর অফুরন্ত রহমতের সওগাত সমৃদ্ধ হয়ে কোরবানির মাধ্যমে, ত্যাগ-তিতিক্ষার শিক্ষার মাধ্যমে আনন্দের অনুপম মাধুরী এনে দিয়েছে ঈদুল আজহা। ঈদকে কেবল আনন্দের বা পানাহারের উৎসব বলে মনে করলে চলবে না বরং ঈদের উৎসব পালনের মাধ্যমে সৌভ্রাতৃত্ব, তাকওয়া অর্জন এবং প্রিয় জিনিস ত্যাগের মহান ও অনুপম তাৎপর্য রয়েছে তা উপলব্ধি করতে হবে।
ধর্মীয় অনুশাসন পালন করাই ঈদুল আজহার একমাত্র উদ্দেশ্য নয়, বরং এর উদ্দেশ্য হচ্ছে সব মানুষের সাথে পারস্পরিক সম্ভার, আন্তরিকতা এবং ভদ্র-ন¤্র আচরণ করা। আত্মীয় ও পাড়া-প্রতিবেশিদের সাথে বেশি বেশি মিলিত হওয়া প্রয়োজন। ঈদের দিনে দুই রাকাত ওয়াজিব নামাজ আদায় করতে হয়। ঈদের দিন সকালে মুসলমানদের ময়দানে বা ঈদগাহে গিয়ে একত্রে নামাজ আদায় করতে হয়। আমাদের নবী হজরত মুহাম্মদ সা: ও খোলা ময়দানে গিয়ে ঈদের নামাজ আদায় করতেন। নবীজীর মতো মুসলমানদের ধনী-দরিদ্র এবং গরীব-দুঃখী-সচ্ছল সবার সাথে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় ও কোলাকুলি করা কর্তব্য। এর মাধ্যমে আমরা একে অন্যের সৌভাগ্যের, আনন্দের অংশীদার হতে পারি। সুতরাং আমরা বলতে পারি ঈদ হচ্ছে একটি অনুপম সামাজিক উৎসব। আর ঈদুল আজহার উৎসব পালিত হয় ওয়াজিব নামাজ এবং কোরবানির মাধ্যমে।
কোরবানির ইতিহাস: কোরবানির ইতিহাস ততটা প্রাচীন যতটা প্রাচীন মানবেতিহাস। পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম কোরবানি হলো হজরত আদম আ: এর দুই পুত্র হাবিল ও কাবিলের কোরবানি। তবে এই কোরবানির ইতিহাসে সবচেয়ে ভাস্কর ও সবচেয়ে উজ্জ্বল হয়ে আছে হজরত ইব্রাহিম আ: এর কোরবানি। তিনি শুধু একটি স্বপ্নের ইঙ্গিতে আল্লাহকে সন্তোষ্ট করার মহান উদ্দেশ্যে চোখ বাঁধা অবস্থায় কোরবানি দিয়েছিলেন তার কলিজার টুকরা নিজ পুত্র ইসমাঈল আ: কে। কিন্তু আল্লাহর প্রয়োজন ছিল না ইসমাঈল আ: এর, প্রয়োজন ছিল হজরত ইব্রাহিম আ: এর মন পরীক্ষা করার- যে আমার খলিল ইব্রাহিম আমাকে খুশি করার জন্য তার প্রিয়তম বস্তু দান করতে পারে কিনা। হজরত ইব্রাহিম আ: পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন। আল্লাহ ইসমাঈল আ: কে সরিয়ে সেখানে রেখে দিলেন দুম্বা। আর তাই দুম্বাই কোরবানি হয়ে গেল। কিন্তু হজরত ইব্রাহিম আ: তার ধারণামতো পুত্রকেই কোরবানি দিলেন; ভেসে উঠল সেখানে জান্নাতি ছবি। হজরত ইব্রাহিম আ: এর মুখ থেকে ছুরি চালনার সাথে সাথেই নিঃসৃত হচ্ছিল- ‘আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ। দুম্বার গলায় ছুরি চালানোর আগ পর্যন্ত হজরত ইসমাঈল আ: এর মুখেও ছিল ওই একই ধ্বনি ‘আল্লাহু আকবার…।’ আর ওই সময়ে আগত লাখো ফেরেশতার মুখেও ধ্বনিত হচ্ছিল ওই একই দোয়া ‘আল্লাহু আকবার…।’
কোরবানির শিক্ষা তথা আমাদের করণীয়: প্রকৃতপক্ষে পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কোনো পিতা আছেন কিনা যে তার কলিজার টুকরো পুত্রকে নিজ হাতে জবেহ করতে প্রস্তুত? কিন্তু হজরত ইব্রাহিম আ: আল্লাহর প্রেমে পাগলপারা হয়ে যে কঠিনতর আদেশ স্বেচ্ছায় হাসিমুখে বরণ করে নিয়েছিলেন, এটাই হলো আল্লাহর প্রতি প্রকৃত আনুগত্য করা। তাই এটাই মুসলমানদের জন্য আনুগত্যেল সঠিক নমুনা। কোরবানি মুসলমানদের আল্লাহর প্রতি আনুগত্য, মহব্বত, প্রেম-ভালোবাসার জন্য ত্যাগ স্বীকার করতে উৎসাহ দেয়। ইব্রাহিম আ: এর কোরবানি আজও সূর্যের মতো প্রদীপ্ত, উজ্জ্বল এবং কেয়ামত পর্যন্ত তা থাকবে। আর এ কারণেই আল্লাহর জন্য সুমহান কোরবানির নমুনারূপে উম্মতে মুসলিমার জন্য অনুকরণীয় আদর্শ হিসেবে চিরদিন পালিত হবে। তাই পৃথিবীর সব মুসলমান কোরবানি পালন করে আসছেন। এ আত্মত্যাগ বা কোরবানির শিক্ষা এই যে, সাচ্চা মুসলমান এবং আনুগত্যকারীরাই তো সেই বান্দা, যে আল্লাহর জন্য তার সব কিছু কোরবানি করতে রাজি। তবেই তা হবে ইব্রাহিম আ: এর ত্যাগের নমুনা। মুসলমানদের জান ও মালের প্রকৃত মালিক আল্লাহ। তাই তো আল্লাহ আল কুরআনে ঘোষণা করেছেন-
‘বলো আমার নামাজ, ইবাদত-বন্দেগি, দান-খয়রাত উৎসর্গ, জীবন-মরণ সব কিছুই আল্লাহর জন্য।’
এ কথা কেবল মুখে বললে হবে না। মুসলমানদের বাস্তবজীবনে আল্লাহর দীন কায়েমে এবং তাদের জান ও মাল আল্লাহর রাস্তায় কোরবানি করতে হবে। গরীব-দুঃখী এতিম মানুষ যখন কোরবানির গোশত খেয়ে খুশি হয়, তখন আল্লাহও খুশি হন। আবার কোরবানির চামড়ার টাকাও গরিব-মিসকিনদের মুখে হাসি ফোটাতে সাহায্য করেন। সর্বোপরি কোরবানির শিক্ষা হলো আল্লাহর আনুগত্যের মাধ্যমে আল্লাহর আইন ও সৎলোকের শাসন কায়েম করার শিক্ষা গ্রহণ করা। তবেই একটি সুখী-সুন্দর সমাজব্যবস্থা কায়েম করা সম্ভব হবে।