
দিগন্ত বাণী রিপোর্ট ॥
২৬শে মার্চ রক্তাক্ত এক ইতিহাস। প্রতি বছরই ২৬শে মার্চ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় আমাদেও স্বাধীনতার রক্তাক্ত ইতিহাস। বাংলার স্বাধীনতাকামী মানুষের আকাংখা আর আত্মত্যাগের ইতিহাস। এই দিন বাঙ্গালী জাতির বীরত্ব ও সাহসিকতাকে গর্বের সাথে স্মরণ করিয়ে দেয়। আমরা গর্বিত বোধ করি এজন্য যে আমরা বাঙ্গালী জাতি বীরের জাতি। আমরা জীবন দিতে পারি কিন্তু আমাদের স্বাধীনতাকে বিসর্জন দিতে পারি না । আমাদের স্বাধীনতা, সম্মান বিকিয়ে দিতে পারি না। আমরা অধিনতা স্বীকার করে নিতে পারি না। ১৯৭১ সালের মার্চেই জাতি তাই চুড়ান্ত শপথ নিয়ে জীবনের মায়াজাল ছিন্ন করে ঝাপিয়ে পড়ে। তরুণ, যুবক, বৃদ্ধ, নারী, পুরুষ সবাই। সেদিন পশ্চিম পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠি আমাদের শোষণের নাকপাশে বন্দি করতে চায়। তারা আমাদের হৃদয়কে আত্মসম্মানকে অপমান করে। চাকরের মত অধীনস্তের মত আমাদের শোষণ করে ক্ষমতার মসনদে থাকতে চায়।
২৫ মার্চের কালোরাতে পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক নেতৃত্ব এ অঞ্চলের মুক্তিকামী নিরস্ত্র জনতার ওপর জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞ চালায়। আর এতেই বাঙ্গালী জাতি শপথ নেয় স্বাধীনতার। ছিনিয়ে আনার প্রত্যয় ব্যক্ত করে স্বাধীনতার লাল সূর্য। ২৫ মার্চ রাতেই পাকিস্তানী সেনাবাহিনী গণহত্যায় মেতে ওঠে। এতে সমগ্র জাতি দিশেহারা হয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। বাঙ্গালী জাতির নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ২৫ মার্চ গভীর রাতে তার বাসভবন থেকে গ্রেফতার করা হয়। এ পরিস্থিতিতে রাজিৈতক নেতারা যে যার মত আত্মগোপন করেন। নেতৃত্বশুন্য করার উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করার ফলে জাতি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। এমন এক দুঃসময়ে চট্টগ্রাম কালুর ঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে আমি মেজর জিয়া বলছি ঘোষণা ভেসে আসে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণার মধ্যে দিয়ে সম্বিৎ ফিরে পায় সমগ্র জাতি। হৃদয় মনে সঞ্চিত হয় শক্তি। জাতি খুঁজে পায় করনীয়। খুঁজে পায় পথের দিশা। ঝাপিয়ে পড়ে চুড়ান্ত স্বাধীনতার সংগ্রামে।
সবার হৃদয়ে যেন বাজতে থাকে বঙ্গবন্ধুর দৃঢ় কন্ঠের ঘোষণা এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম।
২৫ মার্চ রাতে গণহত্যা পরিচালনার সময় পুলিশ, ইপিআর ও সশস্ত্র বাহিনীর বাঙ্গালী সৈনিক ও অফিসাররা বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। চট্টগ্রামে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট মেজর জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে রুখে দাড়ায়। জিয়াউর রহমানের ঘোষণায় সারাদেশে মুক্তিকামী মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয় প্রাণ চাঞ্চল্য। বাঙ্গালী সেনাকর্মকর্তা ও সৈনিকেরা সাধারণ মানুষের সাথে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিচ্ছে এ সংবাদে সাধারণ মানুষকে যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়তে দারুনভাবে উদ্দীপিত করে। এর আগে ২৪ মার্চ পর্যন্ত জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সাথে বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ আলোচনা ক্রমেই ব্যর্থতার দিকে গড়াতে থাকায় অনেকেই যুদ্ধই শেষ পরিণতি তা আচ করে প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকেন। ১৯৭১ এর মার্চের সেই উত্তাল দিন গুলিতে এভাবে প্রস্তুত হতে থাকে মুক্তিকামী স্বাধীনতাকামী মানুষ। দীপ্ত শপথে বলিয়ান হয়ে ঝাপিয়ে পড়ে যুদ্ধের ময়দানে শত্রুর বিরুদ্ধে। পূর্ব দিগন্তে স্বাধীনতার লাল সূর্য উদিত হবে এই প্রত্যাশা নিয়ে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভের পর পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ নানাভাবে শোষিত, বঞ্চিত ও নিপিড়িত হতে থাকে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠির হাতে। এ অঞ্চলের মানুষের প্রতি অবহেলা, উদাসীনতা ও বঞ্চনার কারণে শাসক শ্রেণীর প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলে সাধারণ মানুষ। পুঞ্জিভূত হতে থাকে ক্ষোভ। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে এর বাস্তবচিত্র ফুটে ওঠে। প্রকাশ পায় মানুষের মনের অবস্থা। নির্বাচনে আওয়ামীলীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। কিন্তু শাসক শ্রেণী জনমতের প্রতি সম্মান প্রদর্শন না করে লিপ্ত হয় ষড়যন্ত্রে। ক্ষমতাকুক্ষিগত করে রাখার কুটচালে লিপ্ত হয়। এতে মানুষ নিরুপায় হয়ে রাজপথে নামার পথ বেছে নেয়। শুরু হয় পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের আন্দোলন, সংগ্রাম। বঞ্চিত মানুষের দাবি আদায়ের আন্দোলন। অপ্রতিরোধ ক্ষমতা ছিলো না দমন কিংবা প্রতিরোধের ক্ষমতা ছিলো না ক্ষমতাসীনদের। ফলে ভিন্ন চিন্তা নিয়ে ১৫ মার্চ আলোচনার জন্য ঢাকা আসেন প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান। ১৬ মার্চ থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে আলোচনা শুরু করলে তিনি। কিন্তু সে আলোচনা বা সংলাপে কোন শান্তিপূর্ণ সমাধানের লক্ষ্য ছিলোনা বলে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বরং আলোচনার নামে সময় ক্ষেপন ও একটি প্রতারণা ছিল মাত্র। পশ্চিম পাকিস্তানী নেতারা লোক দেখানো আলোচনার নামে এবং আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের কথা বলে গোপনে অস্ত্র ও সৈন্য বাড়াতে থাকে পূর্ব পাকিস্তানে। এরই মধ্যে তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী সবকিছু ঠিক করে ২৪ মার্চ রাতে পশ্চিম পাকিস্তানে পাড়ি জমান উচ্চপদস্থ জেনারেলরা। তারা আন্দোলন দমনের নীলনকশা প্রণয়ন করেই ঢাকা ত্যাগ করেন।
২৫ মার্চ রাতে গণহত্যার নির্দেশ দিয়ে পাকিস্তান সেনা বাহিনীর একটি বিশেষ বিমানে ইয়াহিয়া খান করাচির উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করেন। জানা যায়, রাত ১১টার দিকে তিনি করাচি পৌছার খবর ঢাকায় পাঠানোর পরপরই সেনাবাহিনীর গণহত্যা অভিযান শুরু হয়। রাজপথে নেমে আসে ট্যাঙ্ক ও সশস্ত্র সৈন্য। শুরু হয় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এক নির্মম হত্যাযজ্ঞ। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ন্যায্য দাবি আদায়ের আন্দোলনকে চিরতরে স্তব্ধ করতেই শুরু হয় দাবি আদায়ের আন্দোলনকে চিরতরে স্তব্ধ করতেই শুরু হয় হত্যার অভিযান। এ যুদ্ধ একটি অন্যায় যুদ্ধ জেনেও পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠিও আমাদের ওপর তা চাপিয়ে দেয়। কিন্তু শাসক শ্রেণীর সে অন্যায়ের কাছে মাথা নত করতে রাজি হয়নি বাংলার স্বাধীনতাকামী বাঙ্গালী জনতা। তারা সে অন্যায় যুদ্ধকে চ্যালেঞ্জ করে। প্রতিরোধের ডাক দেয়। স্বাধীনতাকামী লাখো মানুষ সে অন্যায় যুদ্ধের বিরুদ্ধে রুখে দাড়ায়। তাদের লক্ষ্য ছিলো স্বাধীনতা আর স্বাধীনতার। পূর্ব দিগন্তে স্বাধীনতার লাল সূর্য উদিত হবে এমন একটি ক্ষণের প্রতিক্ষায় চলে সে নিরন্তন যুদ্ধ।