
্আবু আব্দাল্লাহ আহমাদ :
জগতে মানুষের দুঃখ-দুর্দশা আর অশান্তির মূল কারণ হল অসৎ, অযোগ্য ও খোদাদ্রোহী নেতৃত্ব। এর মোকাবিলা কেবলমাত্র সৎ, যোগ্য পুণ্যাচারী নেতৃত্ব-কর্তৃত্বই পারে পৃথিবীর মানুষের মাঝে শান্তি ফিরিয়ে দিতে। তাই একজন মুসলমানের সকল আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হল সৎ, যোগ্য ও খোদাভীরু নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। আর এটা একক প্রক্রিয়ায় না চললে শুধু ওয়াজ-নসীহত আর দাওয়াতেই সম্ভব নয়। এর বাইরেও বাস্তবসম্মত যুগোপযোগী পন্থায় নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের আমূল পরিবর্তনের চেষ্টা করতে হবে। আর এ লক্ষ্যে আমাদের ১০টি বিষয়ে সম্যক ধারণা লাভ করতে হবে। তা না হলে নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব সম্পর্কেই আমাদের ভুল থেকে যাবে আর এ ভুলের মধ্যেই বর্তমান সমাজ ব্যবস্থা চলমান।
১০টি বিষয় হল-
১. নেতৃত্বের গুরুত্ব: হাদীস শরীফে জাতীয় উত্থান-পতন, গঠন ও ভাঙনের জন্য দায়ী করা হয়েছে জাতিসমূহের আলেম, পন্ডিত, শিক্ষিত, জ্ঞানীজনদের। কারণ জাতিসমূহের নেতৃত্ব, কর্তৃত্ব ও পথ প্রদর্শনের গুরুদায়িত্ব চিরদিনই তাদের উপর অর্পিত হয়ে থাকে। সুতরাং তাদের উপরই জাতির যাত্রার দিকদর্শন অনিবার্য। কারণ আমরা জানি যে, গাড়ীর চালক যেদিকে গাড়ী চালিয়ে যাবে আরোহীরা সেদিকে যেতে বাধ্য।
মিছিলের উল্টো দিকে পদচারণার মানে নিজের বিপর্যয়। সমাজের নেতৃত্ব যেদিকে পরিচালিত, সমাজ সেদিকেই পরিচালিত হতে বাধ্য।
আর এজন্য নীতিহীন, নৈতিকতা বিবর্জিত নেতৃত্বের পরিবর্তে চরিত্রবান, সৎ, আল্লাহ ও রাসূল (সাঃ) বিশ্বাসী নেতৃত্ব অপরিহার্য। এখানেই নেতৃত্বের গুরুত্ব অনুমেয়।
২. সৎ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা: এ মৌলিক বিশ্বাস সকল মুসলমানকেই রাখতে হবে যে, সৎ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা দ্বীন ইসলামের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। আর এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে যা করা দরকার তা হলো-
ক) আল্লাহর আইন ছাড়া অন্য কোন আইন এবং আল্লাহর দাসত্বের শৃঙ্খলা ছাড়া অন্য কোন শৃঙ্খলা না মানার দৃঢ় প্রত্যয়।
খ) ন্যায়নিষ্ঠ খোদাভীরু লোকদের পারস্পরিক সহযোগীতার ভিত্তিতে সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব কায়েম করে সম্মিলিতভঅবে সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব কায়েম করে সম্মিলিতভাবে সৎ ও যোগ্য খোদাভীরু নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রয়াস চালিয়ে যাওয়া।
গ) একাকী ঈমানদার মুত্তাকিন হলেও গোটা ফাসেক, খোদাদ্রোহী তান্ডুতী শক্তিকে সৎ] নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার আহŸান জানিয়ে যাওয়াই কর্তব্য।
৩. নেতৃত্বের ব্যাপারে আল্লাহর নিয়ম: মানুষের মধ্যে দু’টি পরস্পরবিরোধী অথচ পরস্পর ওতপ্রোতভাবে জড়িত দিক আছে। এক. অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। দুই. চিন্তা চেতনা বা জ্ঞান বুদ্ধি। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ স্বভাবতই প্রাকৃতিক নিয়মে চলে তা যে কোন জীবেরই হোক। আর বিবেক-বিবেচনা চিন্তা-চেতনা তথা জ্ঞান-বিবেকের অধীনে চলে। আল্লাহর কাছে ধর্তব্য বিষয় হলো মানুষ তার চিন্তা-চেতনা বা বিবেক-বুদ্ধিকে কোন দিকে পরিচালনা করে তা দেখা। এটাই আল্লাহর নিয়ম। আল্লাহ কাউকে জোর করে নেতৃত্বে বসান না, সরানও না। যেহেতু জ্ঞান-বুদ্ধি, বিবেক-বিবেচনা মানুষকে দিয়ে দিয়েছেন।
৪. মানুষের উত্থান-পতনের কারণ: শুধু দেহসত্তা আর এর পাশবিক দিকটার নাম মানুষ নয় বরং নৈতিক গুণ-গারিমার কারণেই মানুষকে মানুষ বলা হয়। এতদসত্তে¡ও যে মূল জিনিসটি মানুষের উত্থান ও পতন ঘটায় তা হলো নৈতিক শক্তি। মানুষের প্রধান দু’টি দিক আছে আর তা হলো মানবীয় চরিত্র ও ইসলামী নৈতিক চরিত্র। মানুষের উত্থান-পতন নির্ভর করে নৈতিক চরিত্রের উপর। অতএব নৈতিক চরিত্রের শুদ্ধকরণ ছাড়া জাতীয় উন্নতি সাধন সম্ভব নয়।
৫. মৌলিক মানবীয় চরিত্র: মৌলিক মানবীয় গুণ বা চরিত্র বলতে যা বাুঝায় সেসব গুণ-বৈশিষ্ট্য যার উপর মানুষের নৈতিক সত্তার ভিত্তি স্থাপিত হয়। দুনিয়ায় মানুষের সাফল্য লাভের জন্য অপরিহার্য যাবতীয় গুণ-গরিমাই এর অন্তর্ভুক্ত। সৎ-অসৎ, ভুল-শুদ্ধ এ সবের উর্ধ্বে থেকে পার্থিব জগতে সাফল্য অর্জন করার উদ্দেশ্যে এসব গুণ অর্জন করলে সে সফল হবে। সেই সঙ্গে এমনকিছু গুণ অর্জন করা অপরিহার্য যা মনুষ্যত্বের মূল। যাকে সৌজন্য ও ভদ্রতামূলক স্বভাব বলে। এরই বদৌলতে এককজন মানুষ সম্মানিত, মর্যাদাশীল হিসাবে স্বীকৃত ও প্রতিষ্ঠিত হয়। আত্মসম্মান, জ্ঞান বদান্যতা, দয়ার্দ্রতা, অনুগ্রহ, বিশ্বাস, ন্যায়নিষ্ঠ, ওয়াদাপূর্ণ করা, পবিত্রতা, সংযম শক্তি প্রভৃতি এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। অধিকাংশ মানবগোষ্ঠীর মধ্যে যদি এ গুণাবলীর সম্মিলন ঘটে তাহলেই মানবীয় গুণাবলীর মূলধন অর্জিত হয়েছে বলে ধরে নেয়া যায়। এগুলোই মানবীয় চরিত্রের মৌলিক গুণ যার বাস্তব উদাহরণ আসহাবে রাসূল (সাঃ)।
৬. ইসলামী নৈতিকতা: ইসলামী নৈতিকতা মৌলিক মানবীয় চরিত্র থেকে স্বতন্ত্র ও ভিন্নতর কোন জিনিস নয় বরং তার বিশুদ্ধকারী ও পরিপূরক মাত্র। যেমন-
ক) মৌলিক মানবীয় গুণাবলী বস্তুনিরপেক্ষ একটি বস্তু বা অস্ত্রমাত্র। কারো হাতে এটা থাকা শুধু কল্যাণকরই নয় বরং অকল্যাণকরও হতে পারে। ইসলাম এটাকে কল্যাণকর পথে নিয়ে আসে। আর তাই মুসলমানের সকল শক্তি-সামর্থ, শ্রম, সাধনা, নামাজ-রোজা, ত্যাগ, কোরবাণী আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই।
খ) ইসলাম মানবীয় মৌলিক গুণাবলীকে সুদৃঢ় করে এবং চরম প্রান্তসীমা পর্যন্ত এর ক্ষেত্র ও পরিধি সম্প্রসারিত করে। উদাহরণস্বরূপ ধৈর্য্য ও সহিষ্ণুতার কথাই বলা যায়।
গ) ইসলাম মৌলিক মানবীয় গুণাবলীর প্রাথমিক পর্যায়ের উপর মহান উন্নত নৈতিকতার একটি অতি জাঁকজমকপূর্ণ পর্যায় রচনা করে। ফলশ্রæতিতে লোকজন কল্যাণের দ্বার উদঘাটন আর অকল্যাণের পথ রোধকারী বানিয়ে দেয়। অন্য কথায় গঠনমূলক দৃষ্টিতে ইসলাম তার উপর ন্যায়ের প্রচার ও প্রতিষ্ঠা এবং অন্যায়ের প্রতিরোধ ও মূল্যোৎপাটনের বিরাট কর্তব্য পালনের দায়িত্ব অর্পন করে। পক্ষান্তরে ইসলামী নৈতিকতার অভাবজনিত কারণে মানুষ অধৈর্য্য-অসহিষ্ণু, কুফরি ও শিরকি কার্যকলাপে লিপ্ত হয়ে সমাজকে বিষিয়ে তোলে। ¤øান হয়ে পড়ে সকল মানবীয় মৌলিক চরিত্র।
৭. নেতৃত্ব সম্পর্কে আল্লাহর নীতির সারকথা:
ক) যারা ােগ্যতা রাখে তারাই নেতৃত্ব পাবে।
খ) মধ্যপন্থাবলম্বনকারী উত্তম জাতিই নেতৃত্ব পাবে।
গ) আত্মত্যাগের প্রত্যয় নিয়ে সম্মিলিতভাবে যারা তাগুতি শক্তির মোকাবিলায় কাজ করবে তারাই নেতৃত্ব পাবে।
৮. মৌলিক মানবীয় চরিত্র ও ইসলামী শক্তির তারতম্য: মানবীয় মৌলিক চরিত্রের সাথে যদি মৌলিক ইসলামী চরিত্রের সমন্বয় না ঘটে তাহলে জড়বাদিতা-বস্তুবাদীতার প্রভাবে জাগতিক বিষয়াদিই প্রাধান্য পাবে। আর ইসলামী চরিত্রের সমন্বয় থাকলে ইহজগতের চেয়ে পরজগতের প্রাধান্য থাকবে। এর প্রভাবে জাগতিক ক্ষুদ্র বা বৃহৎ স্বার্থ মানুষকে লোভী ও স্বার্থান্বেষী করে না। পক্ষপাতদুষ্ট করে তোলে না। আসহাবে রাসূল (সাঃ) এর সিরাত এর এক দশমাংশও যদি পরবর্তী উম্মতের হয় তাহলেও একটি উন্নত জাতি গঠনে সক্ষম।
৯. ইসলামী নৈতিকতার পর্যায়: ইসলামী নৈতিকতার চারটি পর্যায় রয়েছে-
ক) আল্লাহর মর্জির খেলাফ যাবতীয় কার্যক্রম পরিহার করে আল্লাহর আইনকে প্রাধান্য দেয়া।
খ) ঈমান মানে বিশ্বাসের সাথে, ইসলাম মানে কাজের সমন্বয় রেখে চলা।
গ) সর্বকাজের খোদাভীতি বা তাক্বওয়ার প্রাধান্য থাকা।
গ) আল্লাহ ও বান্দাহর হক সম্পর্কে সজাগ ও সচেতন থাকা। বাহ্যিক আচরণের পাশাপাশি অন্তরে এক্বামতে দ্বীনের প্রত্যয় নিয়ে বাস্তবে তা রূপান্তর করা।
১০. ভুল ধারণার অপনোদন: আল্লাহতায়ালা আম্বিয়া-এ কেরামকে যে উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেছিলেন আর আম্বিয়া-এ কেরাম যা করেছিলেন এর বাইরে যেসব বন্দেগি বা কার্যক্রম যতই আকর্ষণীয় হোক তা পরিহার করে চলতে হবে। নফল এবাদত নিয়ে আপোষের মধ্যে মারামারি না করে এ সময় ও শ্রম তাগুতি শক্তির মোকাবিলায় ব্যয় করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা শতগুণ উত্তম। এ গুণগুলো অর্জন করতে পারলেই জাতির নেতৃত্বের আমূল পরিবর্তন তথা উন্নয়ন সম্ভব।