২৬শে মার্চ সোমবার-২০১৮। আমার বাবার পরকালিন অনন্ত জীবনের পথে যাত্রার শোকাহত দিন। ২৬শে মার্চ ১৯৭১ স্বাধীনতা দিবসটি আমাদের জাতীয় জীবনে একটি ঐতিহাসিক স্মরনীয় ও গুরুত্ববহ দিন। জাতীর ভাগ্যাকাশে সেদিন কালো মেঘের গর্জন পুরো জাতীকে এক অন্ধকার গহŸরে ঠেলে দেয়। একদিকে বাঙ্গালী জাতি স্বাধীনতার আকাংখা বুকে নিয়ে মরনপন শফতে মাঠে নামে, অন্য দিকে পাকিস্তানি জান্তা বাহিনী এ দাবিকে উপেক্ষা করে স্বাধীনতাকামি মানুষের ওপর স্টিম রোলার চালাতে থাকে। মুলত তারা ২৫শে মার্চের রাতেই হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। সমগ্র জাতি উদ্বেগ-উৎকন্ঠা আর হতাশার মধ্যে দিশেহারা অবস্থায় কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে পড়ে। সে সময় কোন আপোষ করার সুযোগ ছিল না। বলাযায়, ২৬ শে মার্চ এক ধরনের আনুষ্ঠানিক রনযাত্রার দিন হওয়ায় জাতীয় জীবনের একটি স্মরনীয় দিন হয়ে আছে আমাদের সাধীনতার রক্তাক্ত ইতিহাসে। এই দিনকে স্মরন করলে আমার বাবার জীবনের কিছু স্মরনীয় ঘটনা হৃদয়ে জেড়ে ওঠে। বাবার মৃত্যু ২৬ শে মার্চের দিনে হওয়ায় সে সব কথা গুলো স্মরন না করে পারা যায় না। বাবার মুখে শুনেছি স্বাধীনতার দিন গুলোতে কিভাবে পদে পদে বিপদের পথ পাড়ি দিয়েছেন। বাবা অনেক সময় সে সব কথা আমাদের কাছে গল্পের মতো বলতেন আর আমরা অনেক আগ্রহ নিয়ে তা শুনতাম। বাবা স্বাধীনতার জন্য অনেক আকাংখার কথা বলতেন। একদিন একটি ঘটনা বলতে গিয়ে বাবা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। সাথে আমরাও যেন বাক হারা হয়ে পড়েছিলাম। স্বাধীনতার উত্তাল দিনে একদিন বাবা যশোর রেল স্টেশনে অবস্থান করছিলেন। তিনি ট্রেনের জন্য অপেক্ষায় ছিলেন। এসময় রেল স্টেশনে পাক বাহিনী ও তাদের দোসররা ঘিরে ফেলে। স্টেশনে অবস্থানরত এবং আশপাশের এলাকা থেকে তারা বিভিন্ন লোকজনকে ধরে এনে একটি মাল গাড়িতে তুলছিলো। যাদেরকে মাল গাড়িতে তোলা হয় তাদেরকে মুক্তি ও পাকিস্তান বিরোধী বলে অভিযোগ দিয়ে ধরে আনা হয়। কারো কোন আপত্তি বক্তব্য বা আবেদন নিবেদন করার সুযোগ দিচ্ছিল না। কোন কথা বললেই মার কিংবা কাউকে মারমুখো হয়ে উর্দ্দুভাষায়-সালে বাঙ্গাল বাত্ মাত্ কর,…..অকথ্য ভাষায় গালাগালি করা হয়। আতঙ্কে কেউ তাদের সাথে বিতন্ডায় লিপ্ত হয়নি। এ পরিস্থিতিতে বাবাকে ধরে নিয়ে মাল গাড়িতে তোলা হয়। আর যাদেরকে মাল গাড়িতে তোলা হয় তাদের শেষ পরিনতি নাকি অনিবার্য মৃত্যুর কুপে ফেলে দেয়া। সে সময় শত শত স্বাধীনতাকামি বাঙ্গলিকে মাল ট্রেনে তুলে নিয়ে কখনো গোয়লন্দ পদ্মা নদীতে ফেলে দিত গুলি করে আবার কাউকে রূপসা নদীতে লাশ ফেলে দেয়া হয়। এ বিষয়ে অনেকেরই জানা ছিল যে কারনে পাক বাহিনী বা পাঞ্জাবিদের হাতে ধরা পড়লে এবং বিদ্রোহী হিসেবে নির্ঘাত মৃত্যু অনিবার্য ছিল। বাবা পাঞ্জাবিদের তেমন কুদৃষ্টিতে পড়ে যান। বাবা বলেন, আমি যতই কৌশল করে উর্দ্দু ভাষায় বললাম, ভাইয়া,মুঝে কিঁউ পাকড়ায়া,মাই আপকো দুশমান নিহি, ভাইয়া মুঝে ছোড় দো। তাতে কোন কাজ হয়নি। উল্টো মারমুখো হয়ে যা তা……। তারপর মাল গাড়িতে তুললো। মাল গাড়িতে আরো অনেককেই ধরে এনে তোলা হয়েছে। পাঞ্জাবি পাকবাহিণী ও তাদের দোষররা আশ পাশে ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন জনকে টেনে হেচড়ে এনে মাল গাড়িতে তুলেছে। বাবা বলেন, এ অবস্থায় আমাকে ধরে আনার পর মনে মনে বললাম ,আজই মনে হয় জীবনের শেষ দিন।আল্লাহকে স্মরন করে মনে মনে বলছি, হে আল্লাহ আমরাতো কোন অপরাধ করিনি বরং এরাই আমাদেরকে অন্যায় ভাবে ধরে এনেছে। হটাৎ আল্লাহর কুদরতের নিদর্শন দেখলাম। রেল স্টেশনের পাশেই মসজিদ থেকে জোহরের নামাজের আজান হলো। আমি অস্থির হয়ে উঠলাম। ভাবলাম ভাগ্যে যা আছে তা তো হবেই কিন্তু আমি নামাজ পড়তে যাবো। আমাদের মাল গাড়ির আশপাশে পাঞ্জাবিরা বিচ্ছিন্ন ভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কেউ যেন ভেগে যেতে না পারে সে খেয়ালও রাখছে। আমি ওদের কিছু না বলেই আল্লাহকে স্মরন করে নামাজ পড়তে যাবো বলে নিচে নেমে সোজা মসজিদের দিকে রওয়ানা হলাম। কোন দিকে দৃষ্টি না দিয়ে সোজা গিয়ে সমজিদে হাজির হলাম,পিছন থেকে কেউ ডাকছে কিনা সে দিকে তাকানোর সময় নেই। সেখানে ওজু করে নামাজে দাড়ালাম। নামাজে দাড়িয়ে রব্বুল আলামিনের কাছে নিজেকে সমপর্ন করলাম। নামাজ শেষ করে মোনাজাত দিয়ে আরো বললাম- হে বিশ^ জাহানের রব, তুমি আমার জীবন এবং মৃত্যুর মালিক, তুমি আমাকে এ জালেমদের হাত থেকে রক্ষা করো……। সমজিদ থেকে বেরিয়ে রেল স্টেশনের বিপরিত দিকের রাস্তা দিয়ে অজানা পথে হাটতে থাকলাম। অনেক মাঠ-ঘাট জঙ্গল পথ পাড়ি দিয়ে চৌগাছা থানা এলাকায় এসে কোট চাঁদপুরের পথ চিনে আসতে অনেক রাত হলো। এছাড়াও বাবার জীবনের অন্য একটি ঘটনা তিনি বলেছিলেন যা স্বাধীনতার এই দিনে বাবার মৃত্যু দিবসে স্মরন হয়। স্বাধীনতার সেই ভয়াল দিনে কে, কোথায়, কিভাবে বিপদে পড়েছে কিংবা পরিবারের অজান্তেই হারিয়ে গেছে তার কোন হিসেব ছিল না। সে সময় একদিন রেল স্টেশনের হাফ কিলোমিটার পশ্চিম দিকে পাঠান বাড়ির কাছে মুক্তি বাহিনী রেল পাটি খুলে দেয়। এ অবস্থায় একটি মালবাহি ট্রেন খুলনার দিকে যাওয়ার পথে দুর্ঘটনার মুখে পড়ে। বিকট শব্দ হয়। আশপাশ কেঁপে ওঠে। এতে পাঞ্জাবিরা রেল স্টেশনে এসে দুষ্কৃতিকারিদের খুজতে থাকে। ওসমান কে? সে এর সাথে জড়িত এই বলে বাবাকে খুজতে শুরু করে। কিন্তু তারা ফেস টু ফেস বাবাকে চেনে না। বাবা এ অবস্থায় কিংকতর্ববিমুঢ়। তিনি কি করবেন কিছু ভেবে পাচ্ছেন না। বাবার এক পরিচিত বন্ধু পাশ থেকে বাবাকে সরে যেতে ইশারা করলেন। হৈচৈ হাঙ্গামার মধ্যে বাবা বিলম্ব না করে দ্রæত সটকে পড়লেন। বাবা বলেন তারপর অল্প দুরে একপি পরিচিত বাসায় গিয়ে মহান আল্লাহর কাছে সেজদায় পড়লাম। পাঞ্জাবিরা অনেক খোজাখুজির পর চলে যায়। বাবা বললেন, আমরা তো কোন অন্যায় করিনি। সেদিনের সে লাইন ভাঙ্গার জন্য বাবার এক পরিচিত পাকিস্তান পন্থি ব্যাক্তি ক্ষুদ্ধ হয়ে বলেছিল- ওসমান, যদি সেদিন তোমাকে আমি পেতাম তবে পাঞ্জাবি নয় আমি নিজ হাতে তোমাকে গুলি করে মারতাম। বাবা বলতেন, আমরাতো কোন অন্যায় করিনি। আমরা স্বাধীনতার আকাংখা করতাম মনে প্রানে। আমি জানি না, স্বাধীনতা চাওয়া কি কোন অপরাধ ?